সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

সমুদ্র ও মানবী

( ১ )
সমুদ্র: তোমার নাম কি?
একা: একা ।
সমুদ্র: ওটা তো তোমার বৈশিষ্ট্য, নাম কি?
একা: একা।
সমুদ্র: প্রতিদিন এই বিকেলে, আমার পাশে দাঁড়িয়ে
কি দেখো তুমি?
একা: তোমাকে ।
সমুদ্র: আর?
একা: তোমার বিশালত্বকে, টিপের মত গোল
সূর্যটাকে—আর . . .
সমুদ্র: আর ?
একা: আর আকাশটাকে ।
( ২ )
সমুদ্র: কেমন আছো?
একা: এইতো ।
সমুদ্র: এ কয়দিন এলে না যে ?
একা: আমার কথা তোমার মনে পড়েছে ?
সমুদ্র: না তো, জোয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, তোমার কথা ভাববো কখন?
একা: ও আচ্ছা, আমি ভাবলাম . . .
সমুদ্র: কি ভাবলে?
একা: কিছু না।
সমুদ্র: বলো, কি ভাবলে?
একা: কিচ্ছু না তো, আজ আসি।


( ৩ )
সমুদ্র: আচ্ছা সারাটাক্ষণ এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন ?
একা: কই নাতো !
সমুদ্র: হুম, তা নাহলে এত চুপ করে থাকো কেন ?
একা: কোথায় চুপচাপ, কথা বলছি তো।
সমুদ্র: আচ্ছা, তুমি কি আমার চেয়েও একা ?
একা: তুমি আবার একা হলে কবে?
তোমার তো আকাশ আছে। সূর্য আছে।
জোয়ারের ব্যস্ততা আছে।
সমুদ্র: থামো।
একা: কেন ?
সমুদ্র: জানো, ইদানীং কেন যেন কিছু ভাল লাগেনা।
একা: কেন?
সমুদ্র: জানিনা, রাতের বেলা জেগে জেগে আকাশপানে
তাকিয়ে থাকি . . .
একা: কি দেখো ওখানে ?
সমুদ্র: কিছু একটা দেখতে চাই, কিন্তু কিছুই দেখতে পাইনা।


( ৪ )
একা: জানো, কাল একটা অদ্ভূৎ স্বপ্ন দেখলাম ।
সমুদ্র: কি স্বপ্ন ?
একা: দেখলাম তোমার কাছে খুব ছুটে আসতে চাইছি কিন্তু
পারছি না . . . তারপর . . .
সমুদ্র: তারপর ?
একা: তারপর আর কি? আসি ।
সমুদ্র: তোমার কি এমন অর্ধেক কথা না বললেই না ?
একা: ( দূরে গিয়ে হেসে) না ।


( ৫ )
সমুদ্র: শোন, আজ পূর্ণিমা ।
একা: তাই?
সমুদ্র: তুমি এই শুক্লা দ্বাদশীর রাতে আসতে পারবে?
একা: পারবো। আসি তাহলে ।
সমুদ্র: (একটু চেঁচিয়ে) শোন শোন, ১টা নীল শাড়ী পরে এসো ।
একা: কেন?
সমুদ্র: আর একটা নীল টিপ । চুল বেঁধো না।
একা: কেন বলবে তো।
সমুদ্র: আজ মেঘেদের ছুটি । তোমার চুল দিয়ে
যদি ফাঁকটুকু ভরে !
একা: (কৌতূহলী) আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না !

( ৬ )
একা: কি অদ্ভূত লাগছে রা-তটা !
আকাশ আজ দারুণ সেজেছে । বাতাসও গায়ে হিম
মেখে এসেছে। ওমা জ্যোৎস্না তো বেলাকে রূপোলি করে সাজিয়েছে !
সমুদ্র: হুম্ , এটাই তো পূর্ণিমা।
একা: সত্যিই চমৎকার । আমাকে নিমন্ত্রণ করেছো
এর জন্য ? খুব ভালো লাগছে ।
সমুদ্র: না তো, আমি তো এ জন্য ডাকিনি?!
একা : তাহলে?
সমুদ্র: জানো এইদিনে আমি সবচেয়ে পাগল হই? আমার ঢেউ দিয়ে তীরের প্রিয়
কোন কিছুকে ইচ্ছেমত ভিজিয়ে দিই ।
একা: ও আচ্ছা ।
সমুদ্র: ( .  .  .)
একা: এ—মা ! আমি একদম ভিজে গেলাম তো !
সমুদ্র: ( . . . )
একা: আমি আসি।
সমুদ্র: এই উৎসবের রাতে আমার ঢেউয়ের জবাব
না দিয়ে যাবে ?
একা:আমার কোন জবাব নেই ।
সমুদ্র: সত্যি-ই নেই ?
একা: না ।
সমুদ্র: ও আচ্ছা, এসো ।
একা:  . . .
সমুদ্র: কি হল? ফিরে এলে যে?
একা: শোন
সমুদ্র: বলো
একা: আমায় এতো দেরি করে ভেজালে কেন ?!

রাজ্য

: জানো, এক রাজপুত্রের সাথে বন্ধুত্ব হল।
- তাই ?
: হুম, এ—কদম শিশুর সারল্য।
কোথা থেকে আটটা নীল পদ্ম এনে
বলল -“রাখো”।
কি আর করা হৃদয়টাকে বিল বানিয়ে
ওর মধ্যে রেখে দিলাম।
- আচ্ছা?
: হ্যাঁ । আর ওকে এত ভালবাসি কেন জানো?
-কেন ?
: ওর কবিতা, ওর গানে কেমন যেন একটা মায়া আছে।
কিন্তু হঠাৎ সর্বনাশ ঘটল কালই ! . . .
- কেন কি হল?
: কাল হঠাৎ সেই শিশু আমায় একলা ঘরে পেয়ে ডাকাতি শুরু করল! আমি বলি- “রাজপুত্র, তুমি তো ডাকাত!”
ও বলে- “উহু, রাজদস্যু। ভয় পেয়োনা রাজকুমারী, যাবার বেলায় ভেট দিয়ে যাব।”
- তা কি ভেট পেলে?
: সারা গায়ে চুমুর কলঙ্করেখা।
- শুনেছি, রাজদস্যুরা একই রাজ্য দু’বার ডাকাতি করেনা।
: মরণ!
- কেন? এখন আবার কি হল?
: আমায় যে ভেটের নেশায় পেয়ে গেল ?!
- ( একটু হেসে। কাছে এসে) ভয় নেই,
রাজপুত্র জানে তুমি-ই এখন তার রাজ্য।

শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

এখনও একান্তে

এখনও বরষায়,
ঝিল ভরে যায় কচুরীপানায়।
এখনও বরষায়,
মস্ত বড় বৃষ্টি ফোটারা
ঘাস চুবোয়।


অথচ এখনও বরষায়,
পথকলি মন আমার
একাই ভেজে,
জানালা ঘিরে,
এই প্রবাসে ।


এখন
এই বরষায়।

তারা খসা

ফড়িঙেরা কখনও কখনও
জোনাকীর সাথে শলা করে,
তারাদের মিছিলে মন দেয়।
এক একটা তারা খসে পড়ে
জোনাক ফড়িঙেরে ;
আলোয় আলোয় চমকায়।
বলে দেয়-
“খসে যাওয়াটা ভান।
খসে যেতে যেতে
অর্বাচীন হওয়াটাই প্রদীপ সত্য।
এ-ই তো মোর ছেলেবেলার গান~
খসে যাই
ভেসে যাই
ঝাঁপ দিয়ে ছুটে যাই।
সাঁই সাঁই
যেতে যেতে -
বহুদূরে
বহুক্ষণ
কেবলই নিজেরে পাই ।”

একটি দোলনার আত্মকথন (শেষ)

মাঝে মাঝে দোল খেতে আসা ছোটদের দল যখন আমার বুকের ওপর চড়ে বসে, আর একে অপরকে দোল দেয়। তখন আমার সর্বাঙ্গ জেগে ওঠে আনন্দে। আমার দড়ির প্রতিটি সূতো, আমার কাঠের পিড়ির প্রতিটি কোষ শিশুদের হৃদছন্দে নেচে ওঠে।
কখনও ওরা  দুজন সঙ্গী মিলে উঠে দাঁড়িয়ে দোল খায়। আমাকে ছোট্ট হাতের মুঠি দিয়ে শক্ত করে ধরে। আর প্রচন্ড দাপটে উড়ে উড়ে একসঙ্গে আমি আর ওরা প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলি। তখনই বোধহয়, আমি আমার জন্মের সার্থকতা টের পাই। শৈশব কৈশোরের অনাবিল উদ্দীপনায় খুঁজে পাই নিজেকে। হারিয়ে যাই আমি !

খিলখিল হাসির ফাঁকে ওদের চোখের কোণে যে নিষ্পাপ আলোর ঝিলিক দেখা দেয়, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমারও আগে সেই আলোর প্রতিফলন ঘটায়, আমারই প্রতিবেশী ডোবার জল ! শরতের বাতাস গায়ে মেখে ঝিলিমিলি আল্পনা এঁকে, দিব্যি শিশুদের আনন্দের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে দেয়, নিঃস্বার্থ জলাভূমি।

এই সবান্ধব জলার ঝিলমিল আঁকিবুকিতে, বাচ্চাদের কন্ঠের সেই অচীনপুরের সারল্যে, শরতের মেঘতুলিতে  পাখামেলা সাদা সারস আর চিরন্তন দিগন্তের ধোঁয়াটে নীলে, ভেসে যেতে যেতে আমি চোখ মেলি।

দূরে যতদূরে চোখ যায় অথবা যায়না।
 কিন্তু আমরা ভেবে নিতে ভালবাসি যে- যায়।
আমাদের দৃষ্টি ঠিক পৌঁছোয়।
অসীমের দেখা পায়!

আমি সেই ভেবে-নেয়া অসীমের দিকে চেয়ে থাকি। আর বাচ্চাদের সাথে আকাশ ছুঁতে ছুঁতে আমি টের পাই- আমার চারপাশটা ক্রমশ ঝাপসা থেকে ঝাপসা হচ্ছে। আমার শরীর হালকা হচ্ছে। আমি চকিতে পেলব পালক হয়ে ভাসছি ।

আমি চোখে দেখি সবুজ। কিংবা হয়তো দেখিনা।
চোখ বুজি।
বোজা চোখে দেখি কালচে বাদামী। কালচে সবুজ। কচি সবুজ। কিংবা দেখিনা। দেখি হলুদ, দেখি হলদেটে, দেখি নীল। হয়তো দেখিনা।
 আমি নীল।
আমি দিগন্ত।
আমি সেই দূর।
 দূর থেকে আরও দূর।
দিগন্তের বিন্দু।  তারও আরও দূরে শূন্যে মিলায় বিন্দু , যতদূর।
তারও আরও পরে যেতে যেতে যেতে ~

 শূন্য ছাঁপিয়ে ... আমি হই বিলীন ।



একটি দোলনার আত্মকথন (৬)

~হারায়ে যারে  খুঁজি এতো
পেলে পরে সঙ্গে নিই না তো!~  ( ধাঁধা )

পথ। হ্যাঁ আকাবাঁকা একটা মেঠো পথই গিয়েছে আমাদের সক্কলকে পাশ কাটিয়ে। যেতে যেতে কিছুটা অংশ বন্ধুর কিছুটা মসৃণ। কোথাও একটু লালচে , কোথাও কালচে আবার কোথাওবা একটু বাদামী মাটির রঙে প্রলেপ মেখে নেওয়া। কোন কুমোরের ফেলে রাখা অসমাপ্ত মাটির কলস যেমন এঁকেবেঁকে ভেঙ্গে যায় ? কিংবা পটুয়ার তুলি থেকে বাড়তি রঙ গলে গলে যখন পড়ে ক্যানভাসের ওপর, নিজের মত করে স্বঘোষিত স্বাধীনতায় এগিয়ে যায় রঙের স্রোত ? শিল্পের  ঠিক সেই বোধ থেকে চলা এই পথ।

তোমায় কি বলবো আমাদের এই পথের কথা। কত শত জানা অজানা মানুষ, গরু, ছাগল , পরিবহন ঝড়-ঝাপ্টা চলে যায় তাঁর উপর দিয়ে। তিনি সকলকে তাঁর পিঠের ওপর দিয়ে যাতায়াতের সমান উদারতা নিয়ে আহ্বান জানান । কি কবি, কি ভিক্ষুক, কি জেলে, কি বেকার, কি শিক্ষক, কি ঝগড়াটি, কি কৃপণ, কি জোয়ান, কি রুগ্ন, কি খুনী , কি শিশু সকলেই সমান অভ্যর্থনা পায়। সমানিধাকারে বিশ্বাসী, কাউকে কোন বিচারের দাঁড়িপাল্লায় না-মাপা, কেবলই শুদ্ধ উদারতা, ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা— যে কারও ধর্ম হতে পারে ; এমন আত্মা আমি আমার জীবনে প্রায় দেখিই-নি বললেই চলে। ( আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনা~ আমার দস্যি বর্ষার দিব্যি !)

এই মেঠো পথ , এই এমন বহু বছর ধরে বেঁচে থাকা মহাজ্ঞানী পথ, আমাকে শিখিয়েছে কি করে সকল কিছুর সাক্ষী হওয়া যায় নিশ্চুপে। কি করে নিঃশব্দে থেকেও, শুধু নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে ভালবাসা যায়। প্রতিদানে কিচ্ছুটি না চেয়ে। ভাললাগা থেকে  কেবলই ভালবেসে অপরের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যেই যে বেঁচে থাকার সকল অমৃত নিহীত, তা ওঁর কাছ থেকেই আমার প্রতিনিয়তো শেখা।

কখনও পথ চলতি কেউ  যদি ওঁর কোন ক্ষতিও করে দিয়ে যায়- এ যেমন সেদিন কোথা থেকে ভারী বিশাল এক ট্রাক , হঠাৎ দানবের  মত ফুঁসতে ফুঁসতে এসে , নরম কাদামাখা নাজুক বৃদ্ধকে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিয়ে গেল!
আমরা ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ওঁর গালের বলিরেখাগুলোকে ট্রাক যাবার পর, কেমন দাঁড়কাকের পায়ের মত আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিলো ! ওর কষ্ট দেখে আর সইতে না পেরে আমি, হলুদ গুল্মী, জংলা, ডোবা, ওপারের মাঠ, পাখি, মৌমাছি, কচুরীপানার বেগুনী , মোটকথা আমরা যারা ছিলাম , সবাই চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম । কি কষ্ট! কি কষ্ট!

তবু ক’দিন পর যখন পথটা একটু থিতু হল। গোধূলি তাকে দেখতে এলো।


: দাদু কেমন আছো এখন? ইস্ কি চাপটাই না গেল বলো, তোমার পিঠের ওপর দিয়ে ! ভাবা যায়?!

 : তা পথ হয়ে জন্ম নিলে একটু তো সহ্য করতেই হয় রে।  বরং ট্রাকটা সেদিন ওর ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী-ই ভার বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, জানিস? এমন অমানবিক পরিশ্রম করলে অচিরেই না ওর শরীরটা শেষ হয়ে যায়।আমার আর আগের মত গতর কোথায় বল, যে পিঠ টান টান করে শুকনো সমতল একটা রাস্তার স্বস্তি দেবো?


 অন্যেকে বুঝতে পারা।
নিজের মত করে বুঝতে চাওয়া।
তাকে হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করা। সে যার সাথেই দেখা  হোক। সেটা জীবনে কেবল একবারের জন্যেও হোক না কেন।
তাকে নিঃস্বার্থভাবে নিঃশর্তে ভালবাসতে পারা-


আর কি বলবো তোমায়? এই হচ্ছে আমাদের সকলের পথ।

বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

একটি দোলনার আত্মকথন (৫)

~রূপকথার গঞ্জে না
  ঘাসের রাজ্যে এসো
  সোহাগ দেবো  আদর দেবো 
  মাদুর পেতে বসো ~

ও ভাল কথা, যাকে জড়িয়ে আমার এই জীবন। যাপন। সে হল একটা গাছ। কান্ড থেকে শুরু করে তার সারা শরীর জুড়ে  হলুদ ফুলঝুড়ি। হলুদ গুল্ম। হলুদ লতা। সে এক আগুনরাঙা কান্ড! এক মাথা ঝাঁকড়া হলুদ ফুলের ঝাঁপি। ঝাড়বাতির মত অজস্র হলদে ঝালর ঝুলছে প্রতিটি শাখা প্রশাখায়, ডালে মগডালে। বেশ সযত্নে নিজেকে সাজিয়ে  খুব নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকে আমার বন্ধুটি। থাকে লাবণ্যে। থাকে দায়িত্বে।থাকে আভিজাত্যে।
দূর থেকে দেখলে পরে কোন গায়ে হলুদের মঞ্চ বলে ভুল হয়। শুধু বর বা কনে আসার অপেক্ষা যেন !
গাছটার হলুদ ঝালরগুলো কেবল যে, অমন মুখ হাঁ করা-কান খারা করা-মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা-অতি উৎসাহী কচি ঘাসেদের দিকে স্নেহভরে ঝুঁকেই থাকে। ঝুঁকে চেয়েই থাকে তা তো নয়! নিজের হলদে গুলোকেও দিব্যি  কোল থেকে নামিয়ে হুঁটোপাটি খেতে দেয় কচি দূর্বাদের সাথে।

তাই হঠাৎ দেখলে আমার হলদে লতা বন্ধুর আশপাশটা কেমন এক নরম মখমলী হলুদ চাদর বলে ভুল হয়! গাঢ়  সবুজ জমিনে হলুদ ডুরে বুনন নকশায়, আদুরে মখমলটি নিজের অজান্তেই আমন্ত্রণ জানাতে থাকে পথের সকলকে।
পাখির দলেরা বিশেষ করে বুলবুলির দল হলুদ লতার ভীড়ে লুকোচুরি খেলতে বড্ড ভালবাসে। পায়ে ও পাখায় রেণু মেখে হলুদ পাপড়িতে ব্যস্ত উড়ে উড়ে বেড়ায় মৌমাছি।

আচ্ছা স্বর্গ কি রঙের হয়? আমার বন্ধুটির মত? আমার হলুদ আপনজনের মত? সেখানে হলুদ সোহাগ থাকে? থাকে তার মখমলী আদর?

একটি দোলনার আত্মকথন (৪)

~বৈষয়িক~
শোন শোন বলি শোন
সকল সুধীজন
বোকা মানুষের জীবন
করি গো বর্ণন।
দোয়েল শালিক তারে
দেখে আফসোস করে
বিষয় সম্পদ লয়ে
যারা হায় হায় করে
সারাদিন ছুটোছুটি
নাই বিশ্রাম
অর্থ উপার্জন-ই
একমাত্র কাম।
মানুষ আমি অন্ধ হই
সৃষ্টি বুঝি নাই
মহাবিশ্ব কেন তৈরী
তাহা জানা নাই~

আমার ঠিক পাশেই রয়েছে একদল বুনোঝাড়। তাদের কালচে সবুজ ডালে পাতায় পাতায় ছিটে ছিটে সব বুনো ফল। আর তারও গভীরে আছে এ পাড়ার চড়ুইদের বিখ্যাত আস্তানা । কিচির-মিচির মিচির-কিচির গল্প আড্ডায় নির্ভেজাল আড়ি পাতা হয় আমার । শুনি তাদের সাংসারিক জল্পনা কল্পনা ।চড়ুইগুলো কেমন যেন মানুষের মত। সকাল সন্ধ্যে শুধু ছুটোছুটি। উড়ে বেড়ানো। কাঁদা থেকে তুলে আনা কেঁচো কতক্ষন ছানাদের ঠোঁটে পুরে দেবে শুধু সেই এক ভোগ-বিলাস।
কিছু ধান-শালিক কিছু দোয়েল মাঝে মাঝে উড়ে এসে বসে, আমার সবচাইতে কাছের জন, হলুদ ফুলেল গাছটায়। গৃহস্থের বাড়ীর দুঃখ সুখের কতই না গপ্পো ঠোঁটে করে নিয়ে আসে এই পাখিদের দল।গল্পগুলো অপ্রাসঙ্গিক হোক আর প্রাসঙ্গিক। দৈনন্দীন হোক। হোক আনুষ্ঠানিক। তারা সব বড্ড বেশীই সাংসারিক । সামাজিক কাঠামোর বিচার বিশ্লেষণের, জীবনের চাইতেও বড় রীতিনীতির বোকা বোকা সব গান। আর তা ভাঙ্গতেই  দোয়েল ধান-শালিকদের মানুষের প্রতি এত আহ্বান!

একটি দোলনার আত্মকথন (৩)

~সে এলো ঝনঝনিয়ে
আঁধার করে সব
ধূসর মেখে ঝাঁপসা হল
জোড়া মাঠের বক ।
জল হাওয়ার পাল তুলে
মেঘের মাস্তুলে
কেউ একজন একলা হল
দোলনা দুলে দুলে~

আমার দাবদাহ দিনের দীর্ঘ অপেক্ষার ইতি টেনে বর্ষা আসে। যে সীমান্তে দৃষ্টি রেখে ক্লান্ত হলো চোখ সে সীমান্তে হঠাৎ দেখি মস্ত কালো যোগ। চারদিক অন্ধকার করা সর্বনাশ নিয়ে, ডাকাতের মত একদল লুটেরা ফেরারী বাতাস মাঠঘাট ভিজিয়ে, আসমান জমিন এক করে আছড়ে এসে পড়ে বুকের ওপর। একের পর এক বিষ্টি বানে কুপোকাত যাবতীয় সব রূক্ষতা। ধূলোবালি শুষ্কতাকে ছুটি দিয়ে সারা গায়ে গোলাপজল আর স্বস্তি দিতে, শ্যামল সুখের স্নিগ্ধ প্রলেপ মেখে দেয় বর্ষা । মুখে বিষ অন্তরে মধু ~ মুখে বৃষ্টিবান অন্তরে স্নিগ্ধতার গান। বর্ষার এ বৈশিষ্ট্য বুঝতে অনুধাবন করতে আমার অনেকটা সময় লেগেই যায় । কচুরীপানার ডোবা, নিচু মাঠ, মাঠের উপর থেকে থেকে যে গর্ত  সব টইটুম্বুর জলে।
হৈ হৈ রৈ রৈ আড়ম্বরতা যখন একটু থিতিয়ে আসে। তখন সারাটাদিন গুঁড়ু গুঁড়ু মেঘ পাল্লা দিয়ে বাজে ব্যাঙেদের অর্কেস্ট্রার সাথে।
আমি ।একটা দোলনা। সব-গা-ভেজানো, সব-গা-ধোয়ানো তণুমন নিয়ে প্রকৃতির এই স্নানোৎসব উপভোগ করি পরম মমতায়। জেগে উঠি আড়মোড়া দিয়ে সতেজ স্নিগ্ধতায়। কাঠ, দড়ি আর কিছু ছোট্ট লোহার পেরেক দিয়ে আমার বসন। ঠিক যেমন মেঘ বৃষ্টি জলে হয় বর্ষার আসন।

বর্ষা আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। গায়ের ধূলোকালি ধুয়ে সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে আমায় যেমন স্নান করায়, তেমনি শত ডামাডোলের ভীড়ের ঠিক নীচে, আমায় উদাস হতে শেখায়। বর্ষায় আমি একলা চলি। একলা দুলি। একলা মনে হাঁটি। এত যে জল চারিপাশে, তবু মস্ত ধূসর আকাশপানে, চোখ ভরে আমি নিজের জলে কাঁদি।


একটি দোলনার আত্মকথন (২)

~শুকনো পাতা, কঠিন রোদ
আমের মুকুল প্রখর হোক~

প্রচন্ড তাপে গ্রীষ্মের এক কাঠফাঁটা রোদে, সত্যিই ফেটে যেতে চায় যখন আমার বুক পিঠ । ঠিক তখন একজন মহানুভব সকলের দুঃখে-দুঃখী এক সুপ্রতিবেশীনি  বাঁশঝাড়, থেকে থেকে ছটাক ছটাক হাওয়া পাঠান আমার দিকে।
আমি তাঁর ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খাই। দোল খেতে খেতে সবিনয়ে ধন্যবাদ জানাই ।
শীতল হই । হতে হতে মগ্ন হই। দূর বনানীর সীমান্তরেখায়।

একটি দোলনার আত্মকথন (১)

~ প্রিয় বিশুদ্ধতা,
কোথায় আছে বলো
নিখাঁদ প্রণয় অমন তরো ? ~

একজন এসে বসে। আমার-বসন্তদিনে-তোমার-বসন্তবেলায় , এমন মন নিয়ে এসে বসে। একাগ্রে। একান্তে। বসে নাচতে নাচতে। বসে কাঁচ রঙা পাখায় সদ্য প্রেমে পড়া তরুণের অস্হির চিত্তে।
আমার প্রতিবেশী যে ডোবাটা, তার বেগুনী-সবুজ কোলাস্জে স্নাত সে ।

তার লেজ থেকে টুপ। টুপ করে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা জল।
প্রেমিকার ঠোঁটের স্পর্শে বুঁদ, আকন্ঠ নীল ফড়িং সে এক। সেই সে রাজকুমার। নিগৃহীত কন্যার চোখের গাড়হো কষ্ট আর ঠোঁটের কোণে অনাবিষ্কৃত-অস্পৃশ্য অরণ্যের দেখা পাওয়া মাতাল এক বিশুদ্ধ প্রেমিক।
বুঁদ নেশার উপচে পড়া এক ফোঁটা আবেগ তার লেজ চুঁইয়ে, মধুর মত গলে পড়ে আমার ডান বাহুর দড়ির গিঁটে।
আমি, “আহ্” বলে শুষে নিই সেই সুরা।
আমার দড়ির শিরা-উপশিরারা কেমন জীবনের স্বাদে টানটান উঠে বসে।

রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৮

মাচা

ছোট্ট একটা মাচা
তার ওপরে ঘর ;
তোমার পাশে রইবো আমি
জন্ম জন্মান্তর ।

আদর চাইলে
চুমু দোব ;
মেঘের বাটিতে ,
পাহাড় বেয়ে আকাশ ছোঁব
দৃপ্ত হাসিতে ।

রাত জেগে যে
পানসি ভাসে;
ফিনিক জোছনায়,
সে আলসীতে সুখ বুনবো
মোদের আঙ্গিনায় ।

টাপুর টুপুর বৃষ্টি এলে
ভুলবো মাচাখানা,
আমার পাহাড় ~
আমার বাড়ী ~
কে করবে মানা?

নদী তখন আমার গায়ে
ছুটছে বিরামহীন ;
ভেজা মাটি নগ্ন পায়ে
পায়েল রিনিঝিন ।

হঠাৎ যখন রাত্রি নামেন
পাহাড় ঘেরা মাচায় ;
পিদিম জ্বেলে বসবো মোরা
ছোট্ট বারান্দাটায় ।

সিঁড়ির ধাপে কাঠের গায়ে
এলিয়ে দিয় পিঠ ;
আয়েশ করে গাইবো তখন
অভিমানের গীত ।