বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

একটি দোলনার আত্মকথন (৫)

~রূপকথার গঞ্জে না
  ঘাসের রাজ্যে এসো
  সোহাগ দেবো  আদর দেবো 
  মাদুর পেতে বসো ~

ও ভাল কথা, যাকে জড়িয়ে আমার এই জীবন। যাপন। সে হল একটা গাছ। কান্ড থেকে শুরু করে তার সারা শরীর জুড়ে  হলুদ ফুলঝুড়ি। হলুদ গুল্ম। হলুদ লতা। সে এক আগুনরাঙা কান্ড! এক মাথা ঝাঁকড়া হলুদ ফুলের ঝাঁপি। ঝাড়বাতির মত অজস্র হলদে ঝালর ঝুলছে প্রতিটি শাখা প্রশাখায়, ডালে মগডালে। বেশ সযত্নে নিজেকে সাজিয়ে  খুব নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকে আমার বন্ধুটি। থাকে লাবণ্যে। থাকে দায়িত্বে।থাকে আভিজাত্যে।
দূর থেকে দেখলে পরে কোন গায়ে হলুদের মঞ্চ বলে ভুল হয়। শুধু বর বা কনে আসার অপেক্ষা যেন !
গাছটার হলুদ ঝালরগুলো কেবল যে, অমন মুখ হাঁ করা-কান খারা করা-মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা-অতি উৎসাহী কচি ঘাসেদের দিকে স্নেহভরে ঝুঁকেই থাকে। ঝুঁকে চেয়েই থাকে তা তো নয়! নিজের হলদে গুলোকেও দিব্যি  কোল থেকে নামিয়ে হুঁটোপাটি খেতে দেয় কচি দূর্বাদের সাথে।

তাই হঠাৎ দেখলে আমার হলদে লতা বন্ধুর আশপাশটা কেমন এক নরম মখমলী হলুদ চাদর বলে ভুল হয়! গাঢ়  সবুজ জমিনে হলুদ ডুরে বুনন নকশায়, আদুরে মখমলটি নিজের অজান্তেই আমন্ত্রণ জানাতে থাকে পথের সকলকে।
পাখির দলেরা বিশেষ করে বুলবুলির দল হলুদ লতার ভীড়ে লুকোচুরি খেলতে বড্ড ভালবাসে। পায়ে ও পাখায় রেণু মেখে হলুদ পাপড়িতে ব্যস্ত উড়ে উড়ে বেড়ায় মৌমাছি।

আচ্ছা স্বর্গ কি রঙের হয়? আমার বন্ধুটির মত? আমার হলুদ আপনজনের মত? সেখানে হলুদ সোহাগ থাকে? থাকে তার মখমলী আদর?

একটি দোলনার আত্মকথন (৪)

~বৈষয়িক~
শোন শোন বলি শোন
সকল সুধীজন
বোকা মানুষের জীবন
করি গো বর্ণন।
দোয়েল শালিক তারে
দেখে আফসোস করে
বিষয় সম্পদ লয়ে
যারা হায় হায় করে
সারাদিন ছুটোছুটি
নাই বিশ্রাম
অর্থ উপার্জন-ই
একমাত্র কাম।
মানুষ আমি অন্ধ হই
সৃষ্টি বুঝি নাই
মহাবিশ্ব কেন তৈরী
তাহা জানা নাই~

আমার ঠিক পাশেই রয়েছে একদল বুনোঝাড়। তাদের কালচে সবুজ ডালে পাতায় পাতায় ছিটে ছিটে সব বুনো ফল। আর তারও গভীরে আছে এ পাড়ার চড়ুইদের বিখ্যাত আস্তানা । কিচির-মিচির মিচির-কিচির গল্প আড্ডায় নির্ভেজাল আড়ি পাতা হয় আমার । শুনি তাদের সাংসারিক জল্পনা কল্পনা ।চড়ুইগুলো কেমন যেন মানুষের মত। সকাল সন্ধ্যে শুধু ছুটোছুটি। উড়ে বেড়ানো। কাঁদা থেকে তুলে আনা কেঁচো কতক্ষন ছানাদের ঠোঁটে পুরে দেবে শুধু সেই এক ভোগ-বিলাস।
কিছু ধান-শালিক কিছু দোয়েল মাঝে মাঝে উড়ে এসে বসে, আমার সবচাইতে কাছের জন, হলুদ ফুলেল গাছটায়। গৃহস্থের বাড়ীর দুঃখ সুখের কতই না গপ্পো ঠোঁটে করে নিয়ে আসে এই পাখিদের দল।গল্পগুলো অপ্রাসঙ্গিক হোক আর প্রাসঙ্গিক। দৈনন্দীন হোক। হোক আনুষ্ঠানিক। তারা সব বড্ড বেশীই সাংসারিক । সামাজিক কাঠামোর বিচার বিশ্লেষণের, জীবনের চাইতেও বড় রীতিনীতির বোকা বোকা সব গান। আর তা ভাঙ্গতেই  দোয়েল ধান-শালিকদের মানুষের প্রতি এত আহ্বান!

একটি দোলনার আত্মকথন (৩)

~সে এলো ঝনঝনিয়ে
আঁধার করে সব
ধূসর মেখে ঝাঁপসা হল
জোড়া মাঠের বক ।
জল হাওয়ার পাল তুলে
মেঘের মাস্তুলে
কেউ একজন একলা হল
দোলনা দুলে দুলে~

আমার দাবদাহ দিনের দীর্ঘ অপেক্ষার ইতি টেনে বর্ষা আসে। যে সীমান্তে দৃষ্টি রেখে ক্লান্ত হলো চোখ সে সীমান্তে হঠাৎ দেখি মস্ত কালো যোগ। চারদিক অন্ধকার করা সর্বনাশ নিয়ে, ডাকাতের মত একদল লুটেরা ফেরারী বাতাস মাঠঘাট ভিজিয়ে, আসমান জমিন এক করে আছড়ে এসে পড়ে বুকের ওপর। একের পর এক বিষ্টি বানে কুপোকাত যাবতীয় সব রূক্ষতা। ধূলোবালি শুষ্কতাকে ছুটি দিয়ে সারা গায়ে গোলাপজল আর স্বস্তি দিতে, শ্যামল সুখের স্নিগ্ধ প্রলেপ মেখে দেয় বর্ষা । মুখে বিষ অন্তরে মধু ~ মুখে বৃষ্টিবান অন্তরে স্নিগ্ধতার গান। বর্ষার এ বৈশিষ্ট্য বুঝতে অনুধাবন করতে আমার অনেকটা সময় লেগেই যায় । কচুরীপানার ডোবা, নিচু মাঠ, মাঠের উপর থেকে থেকে যে গর্ত  সব টইটুম্বুর জলে।
হৈ হৈ রৈ রৈ আড়ম্বরতা যখন একটু থিতিয়ে আসে। তখন সারাটাদিন গুঁড়ু গুঁড়ু মেঘ পাল্লা দিয়ে বাজে ব্যাঙেদের অর্কেস্ট্রার সাথে।
আমি ।একটা দোলনা। সব-গা-ভেজানো, সব-গা-ধোয়ানো তণুমন নিয়ে প্রকৃতির এই স্নানোৎসব উপভোগ করি পরম মমতায়। জেগে উঠি আড়মোড়া দিয়ে সতেজ স্নিগ্ধতায়। কাঠ, দড়ি আর কিছু ছোট্ট লোহার পেরেক দিয়ে আমার বসন। ঠিক যেমন মেঘ বৃষ্টি জলে হয় বর্ষার আসন।

বর্ষা আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। গায়ের ধূলোকালি ধুয়ে সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে আমায় যেমন স্নান করায়, তেমনি শত ডামাডোলের ভীড়ের ঠিক নীচে, আমায় উদাস হতে শেখায়। বর্ষায় আমি একলা চলি। একলা দুলি। একলা মনে হাঁটি। এত যে জল চারিপাশে, তবু মস্ত ধূসর আকাশপানে, চোখ ভরে আমি নিজের জলে কাঁদি।


একটি দোলনার আত্মকথন (২)

~শুকনো পাতা, কঠিন রোদ
আমের মুকুল প্রখর হোক~

প্রচন্ড তাপে গ্রীষ্মের এক কাঠফাঁটা রোদে, সত্যিই ফেটে যেতে চায় যখন আমার বুক পিঠ । ঠিক তখন একজন মহানুভব সকলের দুঃখে-দুঃখী এক সুপ্রতিবেশীনি  বাঁশঝাড়, থেকে থেকে ছটাক ছটাক হাওয়া পাঠান আমার দিকে।
আমি তাঁর ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খাই। দোল খেতে খেতে সবিনয়ে ধন্যবাদ জানাই ।
শীতল হই । হতে হতে মগ্ন হই। দূর বনানীর সীমান্তরেখায়।

একটি দোলনার আত্মকথন (১)

~ প্রিয় বিশুদ্ধতা,
কোথায় আছে বলো
নিখাঁদ প্রণয় অমন তরো ? ~

একজন এসে বসে। আমার-বসন্তদিনে-তোমার-বসন্তবেলায় , এমন মন নিয়ে এসে বসে। একাগ্রে। একান্তে। বসে নাচতে নাচতে। বসে কাঁচ রঙা পাখায় সদ্য প্রেমে পড়া তরুণের অস্হির চিত্তে।
আমার প্রতিবেশী যে ডোবাটা, তার বেগুনী-সবুজ কোলাস্জে স্নাত সে ।

তার লেজ থেকে টুপ। টুপ করে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা জল।
প্রেমিকার ঠোঁটের স্পর্শে বুঁদ, আকন্ঠ নীল ফড়িং সে এক। সেই সে রাজকুমার। নিগৃহীত কন্যার চোখের গাড়হো কষ্ট আর ঠোঁটের কোণে অনাবিষ্কৃত-অস্পৃশ্য অরণ্যের দেখা পাওয়া মাতাল এক বিশুদ্ধ প্রেমিক।
বুঁদ নেশার উপচে পড়া এক ফোঁটা আবেগ তার লেজ চুঁইয়ে, মধুর মত গলে পড়ে আমার ডান বাহুর দড়ির গিঁটে।
আমি, “আহ্” বলে শুষে নিই সেই সুরা।
আমার দড়ির শিরা-উপশিরারা কেমন জীবনের স্বাদে টানটান উঠে বসে।