বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৯

চিঠি। কিন্তু কাকে ? তোমাকে না নিজেকেই?



যে তোমাকে নিয়ে আমি উড়ে বেড়াতাম
 আকাশের নীলে বাতাসের ঢেউ হয়ে ,

যে আমরা পৃথিবীর ভৌগোলিক মানচিত্রে
হেঁটে হেঁটে সবুজ পাহাড় , সোনালী সূর্য
দিগন্তের ঘন নীল ছুঁয়ে কল্পনায় ছবি আঁকতাম।

যখন মেলা হবে, শিশু মনে খিল খিল করে
নতুন ওঠা রেশমি চুড়ি ,  ঝাল ফুচকা,
মানুষের কোলাহল ,
গ্যাস এর আগুন ,
হাওয়াই  মিঠাই ,
ষ্টল গুলোর বাহারি নামে
হারিয়ে যেতে যেতে
গল্প করতাম নিজেদের ছোটবেলার।

কখনো বলিনি
কিন্তু আমি মনে মনে আফসোস কুড়োতাম
সেই তোমার মা-হীন ছোট বেলায় কেন আমার
তোমার সঙ্গে দেখা হলোনা।
আমি ঠিক তোমার বন্ধু হতাম।
আমার হাবিজাবি কালেকশন এ ভরা
ছোট্ট লেদারের বাক্সটা  আমি
ঠিক তোমায় খুলতে দিতেম।

তুমি যখন অমন সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ার
গল্পটি বলছিলে,
যে কারণে মাথায় আঘাত পেয়ে তোমার আজ এত
বড়  একটা মস্তিষ্ক জনিত রোগ। মৃগী রোগ।
মনে মনে আমি তখন ছুটে দৌঁড়ে গিয়ে
আঁচল সামলে সিঁড়ি ভেঙে কোলে তুলে নিচ্ছিলাম তোমাকে।
তখন আমি অনায়াসে তোমার মা।
আমি বেঁচে থাকতে কখনো
আমার ছেলে কে চোখের আড়াল-ই হতে দিতেম না।
সিঁড়ি  থেকে গড়িয়ে পড়া তো কত বড় ঘটনা!

তোমার এস. এস.সি.  এইচ.এস.সি.'র রেজাল্ট
ভালো হওয়া না হওয়া
বিদেশে গিয়ে লেখা পড়া শেষ হওয়া না হওয়া
কোনো ভালো চাকরি হওয়া না হওয়া
এগুলো তে মন নেই তো আমার।

ওসব কত টাকা কামাই করা, কত বড় গাড়িদৌঁড়ে বেড়ানো , লোক দেখানো ব্র্যান্ড
এসব কিছু তে নেই তো আমি।
ছিলেম-ই না কখনো।


যখন হঠাৎ লোকেরা এসে বললো
তোমার-ই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু
যে-  তোমার নাকি নারী-সঙ্গ দোষ আছে।

শুনে আমার একটুও বিশ্বেস হয়নি তো।
কেন হবে?
যখন কিছু দিন পর
আরেক নারীর পাঠানো চিঠি
তোমার সঙ্গে হোটেলে থাকার অন্তরঙ্গ
ছবি , সুইমিং পুলে , হেসে দাঁড়িয়ে
জড়িয়ে ধরে, ভালোবেসে, পানিতে ডুবে গিয়ে ,
সমুদ্রের বালুতে আঁকা নিজেদের প্রতিচ্ছবি।


তখনও তো বিশ্বেস হয়নি আমার!
কেন হবে!

যখন তোমার মেয়ে বান্ধবী আমাকে লিখে পাঠায়-
আমার সাথে বিয়ের মাস খানেক এর পর থেকেই তুমি নাকি
অসুখী।
অথচ। ...
ঠিক তক্ষুনি সেই মেয়ের চিঠি পড়তে পড়তে স্মৃতিতে আমার ভাসছে  -

রাত জেগে তারা দেখতে দেখতে শব্দ-শব্দ খেলায়
যখন ভীষণ মজে গেছি। আমরা একদিন।
তুমি হঠাৎ খেলা থামিয়ে দুম করে জানতে চাইলে,
মরে  গেলে আমি, আমার কবর কোথায় চাই।
যথার্থ কারণে আমার উত্তর টা ছিল "আমার বাবার পাশে।"
শুনে তুমি বললে, "আচ্ছা তাহলে তো আমাকে আমার বাপ-দাদার
পারিবারিক কবর ছেড়ে তোমার শহরে এসে কবর করতে হবে।"
আমার 'কেন' প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলে তুমি ,
"আমি কি করে থাকবো মৃত্যুর পর তোমাকে ছেড়ে আলাদা?
পৃথক দুটি শহরে। দুজনে ?"

তখন আমি মনেমনে, মস্তিষ্কে,  মাথায়, হৃদয়ের রক্তপাতে ভেসে লাল ক্ষত- বিক্ষত স্মৃতি হাতড়িয়ে হিসেবে করছি। ..এ কথা টা তো তোমার বিয়ের এক বছরেরও পরে বলা...তাহলে বিয়ের কয়েক মাস পর....যা বলেছে মেয়েটা।...


পরে।  কিছুদিন পর যখন জানা গেলো আমাকে নিয়ে যা- তা রটিয়ে বেড়াচ্ছ তুমি।
যা নয় তাও। যা ছিল গোপন।  শুধু দুজনার তাও।
যা ছিল বিড়ম্বনার কিন্তু নিজস্ব আপন তাও।
যা ছিলোনা। কোনোদিন ঘটেনি।  তাও।


তখন মনে মনে , বিশ্বাস করো
আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম।
নিজের ভিতর ঢুকে পড়ে আরও আড়ষ্ট
হচ্ছিলাম এই বোধ থেকে নয় যে আমার কথা লোকে কি ভাববে।
লোকে কি ভাবছে।
বরং এই থেকে, এই  বোধ থেকে যে
পৃথিবী তে যে মানুষটিকে সবচাইতে আপন, কাছের।  সম্মানের।
আদরের।  শ্রদ্ধার। বিশ্বাস এর উঁচু আসনে আমি বসিয়ে ছিলাম আমার মা বাবার পর।
বন্ধুত্বের।  আহল্লাদের। অরণ্যের।  নদীর।
একটা গড়িমসি অলস সকালের অভ্যস্ততার মতো করে।

উল্টো জামা ছেঁড়া টি-শার্ট পরে ঘরময় হেঁটে বেড়ানোর কিংবা না বেড়ানোর
মতো আরামের যে সহজ সুন্দর সম্পর্কের একটা মাঠে দিব্যি আমার মন
এক্কা  দোক্কা খেলে বেড়াচ্ছিল।

সেই মানুষটাকে আমার চোখে এত টা নিচে নেমে যেতে দেখাটা আমি
বিশ্বেস  করতে পারিনি। এ হতেই পারেনা!
যে মানুষ আমার সাথে দিনের পর দিন অন্য কে শ্রদ্ধা করার, সম্মান দেবার নানা রকম উদাহরণ নিজের অজান্তে দিয়ে গেছে।  তাকে কি করে আমি ছোট হতে দেখতে পারি!

মাঝে মাঝে আমি আমার ঘর থেকে বেরুই।  বেরিয়ে ঘরের সামনে খোলা আকাশের দিকে হা করে চেয়ে থাকি।

ঠিক যেমন টা হা করে শুনেছি আমি তোমার মুখে বলা স্বরচিত, মিথ্যে, আধা-মিথ্যে গল্প গুলো আমাকে নিয়ে।

আমি কোনো উত্তর পাইনি সেদিন।  আজও  পাইনা।
আকাশ শুধু আমার সামনে তার অনন্তের ক্যানভাসটা  মেলে ধরে আমার অবাক হবার ব্যাপ্তিটুকু  তুলে ধরে আমার সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
হয়তো একেই বন্ধুত্ব বলে।  হয়তো একেই সম্মান বলে।  ভালোবাসা বলে।
নিঃশব্দে থেকে শুধু পাশাপাশি সহ- অবস্থান করে যে আপন হওয়া। তা সত্যি-ই কোথাও গিয়ে আকাশের মতো বিশাল একটা সম্পর্কই। বড্ড 'ক্লিশে'  শোনায় যে কথা গুলো- সেগুলোই  নতুন করে উপলব্ধি করছি।

"তুমি যদি আমার সাথে আমার মৌনতাই না ভাগাভাগি করে নিতে পারো ,
তাহলে তুমি আমার কথা গুলো , ভাবনা গুলো কিভাবে ভাগাভাগি করে নেবে?!"

নতুন করে জীবনকে যেন শিখছি, জানো?
মূল্যবোধ আশা-প্রত্যাশা।  আদান-প্রদান।  সমঝোতা।
এসব আবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে শিশুর মতন শিখছি। এ এক নতুন বর্ণ পরিচয়ে,  জানোতো ?

কি জানি আজকাল একটা শিশুকেও বিশ্বাস করতে ভয় পাই।  কারো সঙ্গে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে ভয় পাই।
কেউ আগ বাড়িয়ে কৌতূহল দেখালে গুটিয়ে যাই।  দৌঁড়ে পালাই।

এসব গুটিয়ে চলতে চলতে।  দৌঁড়ে  পালাতে পালাতে যখন আবার নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই । আকাশটার  নিচে।
তখন একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায় লক্ষ্য করি, আমার এই পালানোটা  আসলে কার থেকে?
কিসের থেকে?
আমি তো আসলে তোমায় এখনো ভালোবাসি।
এখনো বুক জুড়ে সেই টনটন ব্যাথাটা একইরকম বিষ ছড়ায়। সুখ দেয়।
বুকের খাঁচা ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চায় তোমার অবহেলিতো আমি। আমার আর্ত চিৎকার-  "ভালোবাসি  এখনও " ।

তবু এ স--ব কিছু ছাঁপিয়ে , সব কিছু উজাড় করে বাতাসে শুকনো কান্না, ভেজা শ্বাস মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।
দাঁড়িয়ে থেকে আমি দেখি।  যা রয়ে গেছে ভিতরে, তা এখনো শুধুই এক অতি নিষ্পাপ প্রেম।
একটা সূক্ষ্ণ শুদ্ধ অনুভূতি। একটা স্বর্গ।

আর তাই বলেই হঠাৎ আমি আবিষ্কার করি, মনের ভিতর জুড়ে আমার বসবাস ক্ষমার।
কোনো জেদ নেই।  ক্ষোভ নেই। অভিযোগ নেই। হিংসা-প্রতিহিংসা নেই। রাগ নেই।
দুঃখ নেই।

শুধুই ক্ষমা। আমি ক্ষমা করি আমাকে। তোমাকে।  ওই অঞ্জন এর গান এর মতো মনে পড়ে-
"আমার আকাশ কুসম স্বপ্ন দেখার
খেলা থামেনি।
শুধু তুমি চলে যাবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!"

ক্ষমা করি এই অপ্রস্তুতির  জন্য নিজেকে । ক্ষমা করি নিজেকে তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য বোকা বোকা সব কান্ড-কীর্তি ,  কথা তৈরির জন্য।  ক্ষমা করি আমি আমায়। ক্ষমা করি আমি তোমায়। যখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো তখন গিয়ে তো অন্য কে ক্ষমা করা যায়।
অক্সিজেন অন্য কে দেবার আগে নিজের ফুসফুসে তো আগে নিতে হয়, সেই অন্য কে বাঁচাবার প্রয়োজনেই।

তাই এই আমার ছোট্ট এক টুকরো পাহাড়ের, সমুদ্রের পাশের ঘর।  এই ঘরের বাইরের  মাঠে দাঁড়িয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পাহাড় সমুদ্র সাক্ষী রেখে-

আমি ক্ষমা করছি আমাকে। আমি ক্ষমা করছি তোমাকে। আমি ক্ষমা করছি সকল প্রাণী।  সকল মানুষ কে যারা আমাকে জেনে না জেনে কষ্ট দিয়েছে। আমি কষ্ট দিয়েছি। আমি কষ্ট পেয়েছি  ভুল বুঝে।

ভালো থাকি আমি।  ভালো থেকো তুমি। ভালো থেকো তোমরা। ভালো থাকুক তারা।
পৃথিবী উত্তাল হউক শুধু ভালোবাসায়। শুধুই আশীর্বাদে।  শুভকামনায়।  শান্তিতে।
প্রশান্তি তে। ক্ষমায়। মুক্তি তে।

আমীন।।