তখন যেমন যেথায়-ই থাকুক না কেন সে। ঘন ছাইরঙা আকাশে উড়তে চাইতো তার চিল-মন।
আকাশের ছাই-মেঘ কালি-মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতো , তার চঞ্চল হৃদয়।
সম্ভব হলে এক ছুটে খোলা ছাদে। সিমেন্টের গরম মেঝের আঁচ সইতে সইতে পায়ের তলা। ঘন হয়ে আসা মেঘের বড় বড় দুরন্ত জল ফোঁটাদের দিকে মুখ করে, এক অস্তিত্ব পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সে। বৃষ্টি-আসি বৃষ্টি-আসি মুহূর্তে। তার ফুসফুস ভরে যেতো সোঁদা সুখের গন্ধে।
আর আবদারী কন্যার আহ্লাদী বাবার মত এক রাশ বৃষ্টি আনন্দ হয়ে নেমে আসতো ওর বুকে।
সবুজ - কচি কলাপাতা সবুজ।অথবা বটল গ্রীন। কিংবা দূর্বা সবুজ। জগতের সব সবুজ ছিল তার প্রিয়। এত প্রিয় যে নিজেকে অবলীলায় এক ঘন সবুজ অরণ্য মনে করতো সে মাঝে সাঁঝেই !
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যেদিন মেয়েটির বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কে চমকে দিয়ে, ওর পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় কণ্ঠটি হঠাৎ বলে ওঠেছিলো,
"আমি আর তোমাকে চাইনা। হ্যাঁ , এতদিন একটা ভালোলাগা ছিল। তোমার দুরন্তপনা। শিশুসুলভ হাসি সব সহ্য করেছি আমি। কিন্তু জীবনটা তো শৈশব নয়। তোমার মতো ছেলে মানুষ নয়। সত্যি বলতে এসব আহ্লাদ তোমার বয়সের সাথে যায় কি?
আমি ভালবাসি আরেক পাখি কে। সে ধীর। স্থির। বেশ গোছানো। পরিপাটি। তোমার মতো নিজ জগতে ডুবে থাকা খামখেয়ালি অরণ্য নয়। নেই তার চোখে থেকে থেকে কোন উদাসপনা।
সে জানে একজন পুরুষ কি চায় তার কাছে।কি করে হাঁটতে হয়। থামতে হয়। হাসতে হয়। কি করে মিষ্টি সুরে চেনা গান গাইতে হয়। সে আমার ময়না পাখি।
নেই তার কোনো তোমার মত সত্য বলার কর্কশ অভ্যেস। সে জানে পুরুষকে পুরুষ নারীকে নারী বলা। লিঙ্গ হয়ে জীবন কাটাবার পদ্ধতি। জানে লিঙ্গের সামাজিক দায়িত্ব। এক পুরুষ এক নারীর কাছে যা চায় তা সে স্পষ্ট বোঝে। নিজেকে মানুষ বা পুরুষ কে মানুষ ভেবে , লিঙ্গের সমতা বা সমঅধিকার চর্চার কোনো অদ্ভুত জেদ নেই তার। নেই বাড়ি-না-গড়ে, গাড়ি-না-চড়ে নৌকো বানানোর এক উদ্ভট পাগলামি ! নেই তার জীবনের কোনো অবাস্তব শ্লোগান তোমার মতন। এই যেমনটা তুমি আওড়াও -
'কেয়া পাতার নৌকো গড়ে
সাজিয়ে নেবো ফুলে
খরস্রোতে ভাসবো মোরা
চলবো দুলে দূলে। '
আমার পাখি সমাজ চেনে। আচার মানে। অর্থনীতির সংসার জানে।"
-প্রিয় কণ্ঠে ফুটে ওঠেছিলো শখের পুতুল কিনতে পাবার অহংকার সেদিন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
অথচ মেয়েটিকে কিন্তু জলের খোঁজ দিয়েছিলো ছেলেটি নিজেই। মেয়েটি গ্রাম অতো ভালো চিনতো না। ছেলেটি জানিয়েছিলো -
"তোমাকে একবার বর্ষা দেখাবো। আমাদের গাঁয়ে বর্ষা এলে পদ্মফুলে ছেয়ে যায় অঞ্চল। নৌকো বোঝাই করে আমরা শাপলা শালুক তুলতে যাই দল বেঁধে। সে গাঁয়ের ছেলে আমি।"
( আর যা শোনেনি মেয়েটি। কিন্তু কল্পনায় ভেসে উঠছিলো তার-ই নিজস্ব অরণ্যের গাছগুলো। দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। সারিসারি।বিলের জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছায়া সুনিবিড় এক মায়া বিছিয়ে রেখেছে তারই চির চেনা ডালপাতারা । মাথার ওপর এক দিগন্ত আকাশ নির্নিমেষ। কাছে পিঠে একটা ডাহুক ডাকলো কি? নৌকোর গলুইয়ে মাথা রেখে চোখ বুজে, দিব্যি শুনতে পেলো মেয়েটি বৈঠের ডাক। ছলাৎ ! ছলাৎ ! )
"নেবে ? আমায় নৌকো করে ?
তোমার পদ্মগাঁয়ে ? শাপলা বিলে ? আমি শাড়ী। একটা এলোখোঁপা।
আর বুক ভর্তি নরম বাতাস।
নেবে আমায় ?"
উত্তরে ছেলেটি, কাছে এসে চকিতে ওর অধর ছুঁয়ে ছিলো। ( শুধু কি অধর? ছেলেটির ওষ্ঠের উত্তাপে গলে গলে যাচ্ছিলো মেয়েটির পায়ের তলার শক্ত মাটি। অরণ্যে লেগেছিলো কি অদ্ভুত হাওয়া! বেজে উঠলো অচিন পুরের গান। ভেঙে ভেঙে ঢুলে পড়ছিলো খোঁপা। মুদে আসছিলো চোখ। ডাহুকটা ঘন হয়ে বসেছিল ডালে। )
শুনিয়েছিলো গান -
" প্রাণো বন্ধুরে -
কাষ্ঠে লোহায় পীরিত করে
নৌকারে সাজাইয়া গো 'পরে
দুই -এ মিলে যুক্তি করে শুকনাতে থাকবে না।
এখন জলের তরে ভাসে পীরিত রে বন্ধু
জল বিনে সে বাঁচে নারে বাঁচে না
মন জানে আর কেহ জানেনা ।। "-
সেই সেদিন থেকে মেয়েটি ওর আঁচলে বেঁধে নিলো এক অঞ্চল। শাপলা আর পদ্ম বোনা সূক্ষ্ম সূতোর রঙিন আবেগ। পাশে থাকে একটা ছই নৌকো।
যখন যেমন ডাক আসবে সে খোলা আঁচলে এলোখোঁপায়, নৌকোয় পা রাখবে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সবুজ রঙ ভালোবাসতো মেয়েটি।
এক আকাশভাঙ্গা জেদি ঝড় এলো ছাদ জুড়ে সেদিন।
"তোমাকে আমি আর চাইনা।
অরণ্য চাইনা।
সারল্য চাইনা।
অমন অধর চাইনা।"
কথাগুলো আছড়ে এসে পড়ছিলো বুকে। বৃষ্টি এসে গা ঝাঁকিয়ে সুঁই ফুটিয়ে ঝাঁঝরা করে দিতে দিতে চলে গেলো ।
বলে গেলো - নদী মিথ্যে।
ঝিল মিথ্যে।
পদ্ম'র ঝোঁপ মিথ্যে।
বলে গেলো- ভালবাসা বলে কিছু নেই।
কিচ্ছু নেই।
বিশ্বাসে বুক বাঁধেনা আজকাল
হাঁদারাম ও।
শুধু থেকে গেলো সেই গল গল গলে যাওয়া পায়ের তলার মাটি।
তার তলে চোরাবালি। থেকে গেলো টান !
তার তলে চোরাবালি। থেকে গেলো টান !
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
মনে করো , মেয়েটি একটা চোরাবালির ফাঁদ। নিজে তো নয়-ই স্বপ্ন গুলোকেও আর বাঁচাতে পারছেনা তার অতল টানে।
মনে করো, মেয়েটি বসেছিলো ছাদের মেঝেয়। বৃষ্টি এলো।
মুখ ডুবোলো সে তার অরণ্যের আঁচলে।
কিন্তু আঁচল কোথায়? এ তো প্রতারণার জাল।
আঁচলের নৌকোখানি
কাগজের নৌকো হয়ে
ভেসে যায় জলের তরে।
ভাসতে ভাসতে ছিঁড়ে যায়। ছিঁড়ে যাচ্ছে ফুল। পাঁপড়িগুলো। ছিঁড়ে যাচ্ছে অঞ্চল।
তাচ্ছিল্ল্যের সুরে সুরে পৃথক।
আলাদা করে চেনা যায়না।
সে ছলনা? না সোহাগ?
কে প্রতিশ্রুতি। আর কে প্রতারণা।
সে পদ্ম? না শাপলা?
কি আসে যায়?
সে ছলনা? না সোহাগ?
কে প্রতিশ্রুতি। আর কে প্রতারণা।
সে পদ্ম? না শাপলা?
কি আসে যায়?
সেই তো মিথ্যে।
মিথ্যে পদ্ম।
মিথ্যে নীল।
মিথ্যে স্বপ্ন।
মিথ্যে মানুষ।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
মেয়েটি বড্ডো মানুষ ভালোবাসতো।হৈ চৈ। হাসি গান। আড্ডা।
আজ তার যত মানুষে আপত্তি!
মেয়েটি বড্ডো সবুজ ভালোবাসতো। আজকাল কিছু ঘাস, কিছু শ্যাঁওলা, কিছু ফণিমনসারা আগলে রাখে ওকে ।
মেয়েটি বৃষ্টি ভালোবাসতো বলে মেঘেরা আজ ডানা মেলে ছায়া দেয়।আঁজলা ভরে বৃষ্টি আনে। এই সবকিছু ছাঁপিয়ে ভালোবাসতো ও সেই কণ্ঠ আর তার গান । যে ঘোর কাটেনি ওর কোনোদিন।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
তুমি এই এখানটাতে এসে, একটু বসো।
টের পাচ্ছো ওর অস্তিত্ব ?
শ্শ্শ ! কান পাতো সাবধানে।
শুনতে পাচ্ছো ? গুন্ গুন্ ? ...
"আশা ছিল মনে মনে
প্রেম করিমু তোমার সনে
তোমায় নিয়া ঘর বান্ধিমু
গহীন বালুর চরে গো,
গহীন বালুর চরে গো,
গহীন বালুর চরে।
সেই ঘরেতে তোমার আমার
মধুর মিলন হইতো,
তোমার শাড়ীর আঁচলেতে
পরাণ বান্ধা রইতো।
রঙ্গিন কাঁথায় থাকতাম শুইয়া তোমায় বুকে লইয়া,
চাঁদের আলোয় রাইত পোহাইতাম কথা কইয়া কইয়া।
সেই সুখের স্বপন চোখে ভাসে
পরাণ উদাস করে গো ...
গহীন বালুর চরে।
তোমার প্রেমের একটু পরশ
গায়ে যদি লাগতো
ব্যথায় পোড়া বুকেতে এক
সুখের সাগর জাগতো
গায়ে যদি লাগতো
ব্যথায় পোড়া বুকেতে এক
সুখের সাগর জাগতো
তোমার কথা ভাইবা মরি
নৌকা বাইতে বাইতে
কানাকড়ি চাইনা, আহা
তোমারে চাই পাইতে
সেই বালুর চরে কাটতো জীবন
মরণেরও পরে গো ...
গহীন বালুর চরে।।
( গান ১: আমার মন জানে আর কেহ জানে না
লোকগীতি, সংগৃহীত
কৃতজ্ঞতা : তাসনুভা তাবাস্সুম
গান ২ : আশা ছিল মনে মনে
শিল্পী : সুবীর নন্দী
গীতিকার: জহির রায়হান এবং আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
সুরকার: আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
চলচ্চিত্র : হাজার বছর ধরে )
( গান ১: আমার মন জানে আর কেহ জানে না
লোকগীতি, সংগৃহীত
কৃতজ্ঞতা : তাসনুভা তাবাস্সুম
গান ২ : আশা ছিল মনে মনে
শিল্পী : সুবীর নন্দী
গীতিকার: জহির রায়হান এবং আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
সুরকার: আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
চলচ্চিত্র : হাজার বছর ধরে )
এত অসাধারণ একটা কম্পোজিশন তৈরি করার জন্যে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ!
উত্তরমুছুনমাঝে মাঝে কিছু আবেগ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আপনার এই কবিতা পড়ে আমার অবস্থাও তাই হয়েছে। মনে হয়েছে আমার মনটা একটা খোলা খাতার মত চোখের সামনে দেখতে পেলাম.. নিজের মন নিজে পড়া আর অন্য কারো ভাষায় পড়ার মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারিনি। মানুষের আত্মাগুলো যে একই উৎস থেকে আসা- এটাই হয়ত প্রমাণিত হল, আর আমি আরো একবার বিস্মিত হলাম! 😇
~মানুষের আত্মাগুলো যে একই উৎস থেকে আসা ~ কি গভীর উপলব্ধি! আসলে যে যেমন তার কাছে তো যে কোন অভিজ্ঞতার বর্ণনাও তার নিজের মত। আপনি এই অতি সামান্য অতি সাধারণ লেখাকে ‘অসাধারণ কম্পোজিশন’ বলছেন এভাবে দেখছেন। এ
উত্তরমুছুনআপনার দেখার গুন! আমার ভাললাগাটুকু এখানেই যে আপনি এত যত্ন নিয়ে মন দিয়ে
আমার লেখা পড়েন! আবার বার্তি সময় বের করে লেখাগুলো নিয়ে মন্তব্য করেন! একজন লেখক বৈকি মানুষের এমন প্রেরণার উৎস থাকলে আর কি লাগে!
আপনার অনুপ্রেরণাতেই বরং বার বার লিখতে ইচ্ছে করে!
অশেষ কৃতজ্ঞতা তৃষা আপনাকে।
🙏
বাড়তি *
উত্তরমুছুনকেমন উলটো হয়ে গেল না ব্যাপারটা? কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা কিন্তু আমার, কারণ লেখক যদি পাঠকের মন্তব্য গ্রাহ্য না করেন সেখানে পাঠকের কিছু বলা না বলা সমান। আপনি যে মন্তব্যগুলো পড়েন এবং সেগুলোকে এতখানি গুরুত্ব দেন সেই কারণেই না এমন নির্দ্বিধায় মন্তব্য করতে পারি। এই সুযোগটা যে আপনি দিচ্ছেন, এজন্যে বরং আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। 🙏😊
উত্তরমুছুনকিচ্ছু উল্টো কিছু হয়নি।
উত্তরমুছুনসব ঠিক আছে।
কৃতজ্ঞতা 🙏 জানবেন !